11/12/2024 | News release | Distributed by Public on 11/11/2024 22:34
এমুহূর্তে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পার করছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও সেই সূত্র ধরে রাজনৈতিক পালাবদলে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণই প্রমাণ করে, পরিবর্তনকে আর অবরুদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। মূলত সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
এই অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, যে কারণে সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ও অনাস্থা চরম আকার ধারণ করে। পুলিশের এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সাথে সৌহার্দ্য প্রদর্শনের চাইতে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই জরুরি মনে করতো, যে কারণে বাহিনীটি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে এবং সমাজে বিভাজনের পরিবেশ তরান্বিত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগে ক্রমেই পুলিশের উপর জনগণের আস্থা নিম্নমুখী। সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশকে হরহামেশাই মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে উহ্য রেখে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে দেখা যায়। এই তেতো সত্যটি বাংলাদেশের পক্ষে আর অমীমাংসিত রাখা সম্ভব নয়।
বিপ্লবের সময় পুলিশ সদস্যরাও প্রাণ হারান। এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং যাদের রক্ষার জন্য তারা শপথ নিয়েছেন, সেই জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে গভীর ক্ষত হয়ে উঁকি দিতে থাকবে। এ ধরনের ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, কাজের অত্যধিক চাপ, তার উপর প্রয়োজনীয় রিসোর্স ও প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা এবং অনাস্থার পাকে নিজেরাই ভুক্তভোগীর কাতারে চলে যেতে হয়। আর এই সংকটগুলো বাহিনীর সামগ্রিক কার্যকারিতা এবং মনোবলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ১১ দফা দাবিতে স্পষ্ট হয়।
তবে, প্রতিটি সংকট একইসাথে কোনো না কোনো সুযোগেরও জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ, তবে এখানেই থামলে চলবে না। দীর্ঘস্থায়ী, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য সামনে আরো পথ পাড়ি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশিং এ এমন পরিবর্তন তরান্বিত করতে হবে, যাতে করে বাহিনীর সংস্কৃতি, আচরণ, কাঠামো এবং আইনেও বদল আসে। পুলিশ বাহিনীর বর্তমান অবস্থা আর চলতে পারে না-জুলাই ও আগস্টের ঘটনার পর এ বিষয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। আমাদের সামনে জিজ্ঞাসা হল : কীভাবে আমরা এই সংস্কারকে অর্থবহ, টেকসই এবং পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থা পুনরুদ্ধারের কাজে লাগাতে পারি?
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হলে অবশ্যই ১৮৬১ সালের সেই ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ অ্যাক্ট থেকে সরে আসতে হবে-যে আইনে সেবার চেয়ে নিয়ন্ত্রণেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে এবং আবার ২০১৩ সালে, একটি পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের অধীনে নতুন একটি পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়া তৈরিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। এর কাজ চলমান ছিলো ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল অবধি। এই খসড়া অধ্যাদেশটিতে গণতান্ত্রিক, জনবান্ধব পুলিশিং এর লক্ষ্যে, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাসহ জনসাধারণের পক্ষ থেকে তদারকি এবং জবাবদিহিতা আদায়ের বিধান রাখা হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খসড়া অধ্যাদেশ এবং ২০১৩ সালের পর্যালোচনা রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের অভাবে থমকে যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে একটি পেশাদার, জবাবদিহিমূলক এবং দক্ষ পরিষেবাদান-এর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরকে শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিতে পুলিশিং সম্পর্কিত একটি নতুন আইনি কাঠামো প্রয়োজন। এই আইন বলবত হলে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাস্তবায়িত হবে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে এবং পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্য হতে হবে এমন একটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা যা হবে গণতান্ত্রিক, জনমুখী এবং সমাজে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানাবিধ চাহিদা পূরণে করিৎকর্মা। এর জন্য আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে পুলিশ কল্যাণ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ, প্রশিক্ষণ এবং জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির অনুশীলন পর্যন্ত বিদ্যমান ব্যবস্থার সবকিছুরই সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশকে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে আবির্ভুত হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য একটি কাঠামোগত পদ্ধতির প্রয়োজন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনকেও পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।
সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুলিশ এমন একটি বাহিনীতে রূপান্তরিত হওয়া উচিত যা রাজনৈতিক পরিচয়, লিঙ্গ, জাতিগত বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষকে সমানভাবে সেবা প্রদান করবে। প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে পেশাদারিত্ব, সততা এবং নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে, নিশ্চিত করতে হবে সকল নাগরিককে রক্ষার জন্যই পুলিশ; বিশেষত যারা নিপীড়নের মুখে সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত।
পুলিশের কার্যক্রমে অবশ্যই মানবাধিকারের শর্তগুলো মেনে চলতে হবে। এবং এটি শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা নির্বিচারে আটক রোধের বেলায় নয়; পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে প্রতিটি মিথস্ক্রিয়ায় মানবিক মর্যাদা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে, অবশ্যই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশকে অবশ্যই সর্বোচ্চ আচরণগত মান বজায় রাখতে হবে এবং নির্যাতনের ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছতা ও প্রকৃত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশই প্রথম দেশ নয় যারা পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করেছে। নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ইরাক এবং কেনিয়াসহ অনেক দেশে পুলিশ সংস্কারে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিলো। এই দেশগুলোতেও পুলিশবাহিনীর রাজনীতিকরণ এবং জনসাধারণের সাথে বাহিনীর সম্পর্কে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। এসব দেশে আজকের বাংলাদেশের মতোই পুলিশকে জবাবদিহি করা এবং বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থাপনা তৈরিতে জনগণের মধ্য থেকে দাবি উঠেছিলো।
সংস্কারগুলোর উদ্দেশ্য হবে জনসাধারণের প্রয়োজনে, বিশেষত লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা এবং নারী ও শিশুদের মত সবচেয়ে বিপদসংকুল নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদানে পুলিশকে আরো বেশি নিবেদিত করে তোলা। জনগণের সাথে পুলিশের আস্থা পুনরুদ্ধারে কমিউনিটি পুলিশিং একটি অপরিহার্য ও প্রমাণিত পদ্ধতি। স্থানীয় জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী আরো তৎপর এবং কার্যকর হয়ে ওঠে, এবং সেবা পেতে জনগণকে প্রতিনিয়ত কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় সে সম্পর্কে জরুরি ধারনা লাভ করতে পারে বাহিনীর সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশ, কিন্তু এদেশের সংস্কার হতে হবে এখানকার নিজস্ব বাস্তবতার নিরিখে। ২০০৬-২০১৬ সালের পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি কিছু মূল্যবান বার্তা রেখে যায়। যদিও সেখানে মূলত প্রশিক্ষণ উন্নয়ন এবং বাহিনীর কিছু বিষয়ে পেশাদারিত্ব সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু একইসাথে টেকসই সংস্কারের অন্তরায় ও বহুকাল ধরে চলে আসা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও সেখানে উঠে আসে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, স্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য অবিচল রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং জনসাধারণের সত্যিকারের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
সংস্কার প্রক্রিয়ার সাথে অবশ্যই জনগণের সম্পৃক্ততা জরুরি, সংস্কারের পর সে বিষয়ে জনগণের মূল্যায়ন গ্রহণ করে কোনো উপকারিতা নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে তরুণদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন থেকে স্পষ্ট বার্তা উচ্চারিত হয়েছে-অচলাবস্থা আর সহ্য করা হবে না, সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আগামী দিনের অবয়ব নির্ধারিত হতে হবে তরুণদের ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে। শিক্ষার্থী, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং পুলিশের অসদাচরণের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে দেশব্যাপী সংলাপ আয়োজন করা হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব, যেখানে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। বিচ্ছিন্নতার উপর ভর করে আস্থা ফেরানো যায় না, এক্ষেত্রে পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে স্বচ্ছ, অবাধ আদানপ্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়। পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ। কিন্তু সত্যিকারের সংস্কারের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার চেয়েও বেশি কিছু-তা হল নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে জাতিসংঘ প্রস্তুত। অন্যান্য দেশে এরকম কাজে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হচ্ছে-অর্থবহ সংস্কারের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনসম্পৃক্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টা। কেবল পুলিশ বাহিনী নয়, বরং সমাজে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকাকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজাবার এক অনন্য সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। আসুন এই সময়ের সদ্ব্যবহার করে এমন একটি আগামী বিনির্মাণ করি যেখানে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং মর্যাদাই হবে পুলিশ এবং জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের মূল প্রতিপাদ্য।